চম্পকনগর চাকমা বিহারে কিছুক্ষণ এবং কিছু কথা
ভিক্ষু ৰিৰেকাজোতি
গেল ২৪ সেপ্টেম্বর শ্রদ্ধেয় জোতিপালা মহাথের মহোদয়ের সাথে “চম্পকনগর চাকমা বিহার” থেইনতেবেইন শহরে গেলাম। কয়েক দিন বৃষ্টি পরার কারণে বিহারটির চারদিকে প্রচুর পানি জমেছে। আমাদের সাথে এক বার্মিজ চাকমা উপাসক ছিলেন তার নাম উ মিন্টলুং। আমাদের এখানকার চাকমাদের নাম শুনলে বাংলাদেশ ও ভারতের চাকমারা বলে “গোদা মঘ’ নাঙ!” আমরা বড় রাস্তা হতে ভান্তের বিহারে গেলাম পানিতে পা ভিজিয়ে, চারদিকে কাশফুল ফুটেছে শরৎ যে এসেছে সেটা এখানেও বলে যাচ্ছে প্রকৃতি। পানি হওয়ার কারণে শামুক, মাছও প্রচুর জন্মেছে সেখানে। ভান্তের বিহারটির বর্তমান জায়গার পরিমান হচ্ছে ১০০”×৮০” আগে জায়গার পরিমাণ ছিল ৪৫”×৮০” । শ্রদ্ধেয় সেখানে ২৫”×৩০” একটি ধম্মহলের ফাউন্ডেশন করেছেন, আপনারা ছবিতে যে বেড়ার ঘরটি দেখেছেন সেটি ফাউন্ডেশন দেয়া ধম্মহলের উপর নির্মাণ করা হয়েছে।



য়ানগুনে চাকমা বিহার কয়টি?
বেশ কয়েক সপ্তাহ আগে শ্রদ্ধেয় কিত্তি ভান্তে (আমেরিকা) আমায় এই প্রশ্নটি করেছিলেন। আমি আমার জানার পাচঁটি বিহারের কথা সেদিন ভান্তেকে জানিয়েছিলাম। তখন আমি য়ানগুনে চাকমাদের পাচঁটি বিহারের সম্পর্কে জানতাম, তার বেশি না। তাই এর বাইরে থাকতেও পারে বলে উত্তর দিয়েছিলাম। সেদিন (২৪) সেপ্টেম্বর যখন শ্রদ্ধেয় জোতিপালা ভান্তের সামনে পাঁচটি বিহারের কথা তুলেছিলাম, তখন তিনি আমায় আরেকটি নতুন বিহারের নাম বললেন, যেটি নির্মাণ করছেন ভদন্ত সুনন্দ নামের কোন এক চাকমা একটি ভিক্ষু। এবার বলি কোন কোন শহরে এই বিহারগুলি অবস্থিত। বর্তমানে আমার জানা মতে চাকমা বিহারের সংখ্যা ছয়। এর মধ্যে থেইনতেবেইন শহরে তিন (৩) টি, মিংগালাডং শহরে দুই (২) টি এবং মিওক উক্কালা শহরে এক (১) টি। বিহারের নাম শহর ও অধ্যক্ষ’র নাম পাঠকের সুবিধার্থে দিলাম—
১। দাইনেক সাসানাপিউ বিহার, মিওক উক্কালা শহর (ဒိုင်းနက် သာသနာပြုကျောင်းတိုက်) (য়ানগুনে প্রথম চাকমা বিহার), বর্তমান অধ্যক্ষ ভদন্ত উ তেজা।
২। চিনয়াতানা বিহার (စိန်ရတနာကျောင်းတိုက်), মিংগালাডং শহর, (তথ্যমতে দ্বিতীয়), অধ্যক্ষ ভদন্ত উ চান্দাবর মহাথের।
৩। ধাম্মারামা য়িইসা (ဓမ္မာရာမရိပ်သာ), থেইনতেবেইন শহর, (তথ্যমতে তৃতীয়), অধ্যক্ষ ভদন্ত উ ঘোসিতা মহাথের।
৪। অংসিদ্ধি বিহার (အောင်သိဒ္ဓိကျောင်းတိုက်), থেইনতেবেইন শহর, (তথ্য মতে চতুর্থ), অধ্যক্ষ ভদন্ত উ সুমন।
৫। চম্পানাগো চাকমা বিহার (စမ္ပာနာဂိုရ်သက္ကမာကျောင်းတိုက်), থেইনতেবেইন শহর, (তথ্যমতে পঞ্চম), অধ্যক্ষ ভদন্ত উ জোতিপালা মহাথের।
৬। সুনান্দারামা/ওয়েনেয়্যাসুখা (သုနန္ဒာရမကျောင်းတိုက်/ဝေနေယျသုခကျောင်းတိုက်)(তথ্যমতে), মিংগালাডং শহর, (তথ্যমতে ষষ্ঠ), অধ্যক্ষ ভদন্ত উ সুনন্দ।
হয়তো এই প্রশ্নটি আরো অনেকের মনে আসতে পারে। তাই এখানে বিহারের নামগুলির তালিকাও দিয়ে দিলাম। বর্তমানে এই ছয়টি বিহার মায়ানমার চাকমা ভান্তের কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত, এর মধ্যে শ্রদ্ধেয় জোতিপালা ভান্তের বিহারটির কাজ চলছে। এবং শ্রদ্ধেয় সুনন্দ ভান্তের বিহারটির কাজও চলছে সম্ভবত।

একজন জোতিপালা ও একশ নিন্দুক!
কথাটি শুনে হয়তো পাঠকের মনে হয়ত প্রশ্ন জাগতে পারে । কেন? হ্যাঁ, আমাদের দেশে যেমন কাজ করতে গিয়ে নিন্দুকের নানা নিন্দা শুনতে হয়, ঠিক একজন জোতিপালারও নানা ধরনের নিন্দা শুনতে হয় এবং হচ্ছে। আসলে নিন্দাওতো অষ্টলোকধর্মের একটি। জোতিপালা এখানকার চাকমাদের নিয়ে কাজ করছেন, গবেষনা করছেন, ইতিহাস বিষয়ক তথ্য আমাদের সম্মুখে প্রকাশ করছেন, ভারত যাচ্ছেন, বাংলাদেশ যাচ্ছেন, আর সেখান থেকে নিয়ে আসছেন স্বজাতীয় বস্ত্র পিনোন খাদি, ধুদি সিলুম এবং এসব বস্ত্র বিলিয়ে দিচ্ছেন মায়ানমারে বসবাসরত চাকমাদের । যেহেতু এখানকার চাকমারা জোতিপালা কর্তৃক উপকৃত হচ্ছেন, সেহেতু তারা জোতিপালার প্রশংসা করবেন, তাতো মানুষের একটি স্বভাব। আর অনেকেই জোতিপালার এই ভূয়সি প্রশংসা শুনতে পারেন না, না পারেন কাজ করতে আর না পারেন কর্মত ব্যক্তির প্রশংসা শুনতে । এভাবে আসতে আসতে একদল স্বজাতীয় ব্যক্তি জোতিপালার বিরুদ্ধে কুটসা রটাতে লাগলেন। নিন্দা করতে লাগলেন। কিন্তু সেসব ব্যক্তিরা জাতির জন্য কোন কাজই করছেন না। আমার এসব দেখে সত্যিই খারাপ, এখানে নিজের খারাপ লাগার কথাটিই বললাম, যদিও বলার অনেক কিছুই আছে! জোতিপালা মহাথের মহোদয় আমার দেখা চাকমা গবেষকদের মধ্যে অন্যতম। তিনি বাংলা বুঝেন না ঠিকই তার লাইব্রেরীতে বাংলা বইয়ের সংখ্যাও কম নই। আর ইংরেজি, বার্মিজ বইয়ের কথা না হয় বললাম না। তিনি আমার কাছ হতে বাংলা শেখারও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন, শুধু ইতিহাস সম্পর্কে জানার জন্য।


আজ আমরা জানুয়ারি ৭ তারিখ আসলে দেখি মায়ানমারে বসবাসরত চাকমারা “চাকমা ন্যাশন্যাল ডে” পালন করছেন, এই “চাকমা ন্যাশন্যাল ডে” পালনের অন্যতম উদ্যোগক্তা হচ্ছেন শ্রদ্ধেয় জোতিপালা, আজ আরাকানের চাকমা শিশুরা চাকমা বর্ণে পড়তে ও লিখতে পারছেন এর পিছনের ইতিহাস নির্মাতা হচ্ছেন জোতিপালা, হয়তো পৃথিবীর অধিকাংশ চাকমা সেটা জানেন না। অনেকে আবার ভুল ব্যক্তিকে জানেন, যে ব্যক্তিটির কোন পরিশ্রম নেই। এখানে এখন বিহারে গেলে, বিঝুর সময় চাকমা মেয়েরা পিনোন-খাদি পরিধান করেন, আর ছেলেরা ধুদি ও সিলুম এসব আমরা ফেসবুকে অহরহ দেখি আজকাল, আর এই পিনোন-খাদির পরিধান করতে পারার পেছনে যার পরিশ্রম আছে তাকে হয়তো আমরা কমই জানি, চিনি ; তিনিতো এক গৃহত্যাগী ভিক্ষু। তিনি হতে চান বিমল তিষ্য, প্রজ্ঞানন্দদের মত কর্মবীর জাতির কাছে। তাই তিনি তার ধর্মীয় একাডেমিক শিক্ষাকে সমাপ্ত না করেই বেড়িয়ে পড়েন “ঞাতাত্থাচারিয়” চর্চার জন্যে। ছুটে গিয়েছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতে স্বজাতীয় শিখর সন্ধানে, জ্ঞাতী হারা মানুষদের দুঃখকে শোনাতে, হ্যাঁ তিনি পেরেছেন, তিনি শুনিয়েছেন আমাদের মায়ানমার চাকমাদের কথা, দুঃখের কথা, আর তিনি আশা ও স্বপ্ন পেয়েছিলেন বাংলাদেশ ও ভারতের চাকমাদের কাছে। তাই তিনি অদম্য, তিনি কাজ করতে চান আমরণ। তিনি এখানে প্রতিষ্ঠা করতে চান “বোধিয়াচারিয়” এর শাখা, তিনি চান জ্ঞান ও শিক্ষার আলোহীন এই মায়ানমার চাকমারাও বাংলাদেশ ও ভারতের চাকমাদের মত জ্ঞান ও শিক্ষার আলোতে নিজেকে আলোকিত করুক। আর শ্রদ্ধেয় ভান্তের এই মহৎ কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন দেশে থাকা চাকমাদের এগিয়ে আসা আবশ্যক বলে আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি। কারন দশের লাঠি একের বোঝা। হে, জ্ঞাতীবৃন্দ আপনারা কি এগিয়ে আসবেন? আপনারা এগিয়ে আসলে মায়ানমারে থাকা চাকমারা দ্রুত শিক্ষা দীক্ষায় এগিয়ে যেতে পারবে।
সকলের সুস্বাস্থ্য ও নীরোগ দীর্ঘায়ু কামনা করি।
য়ানগুন, মায়ানমার
ভাদ্র, ২৫৬৫ বুদ্ধাব্দ
২৬.৯.২০২১ খ্রিঃ