জুম পাহাড়ের বুকে এক বুনোফুল ফুটেছিল by Supan Chakma

ভূমিকা: জুম পাহাড়ের বুকে এক বুনোফুল ফুটেছিল,সে ফুল হিংস্র জানোয়ারের হাতে পরে তার দেহ হারায়।কিন্তু তার আত্মা এখনও রয়ে গেছে পাহাড়ের গহীনে। আর সেই বুনোফুলের আত্মা খোঁজে ছড়া-বন-দূর্গমটা খোঁজে দুটি উপজেলা পাড়ি দিতে যাচ্ছি। পাহাড়ের বুনোফুলের মাতাল হয়ে থাকা পাখ-পাখালিদের দর্শন করতে বেড়িয়েছি।

সফর সঙ্গী : রাঙামাটি বোটঘাট থেকে দু-চালা একটি বোটে উঠলাম। সঙ্গে দুই সফর সঙ্গী সাজাং চাকমা ও রুপান্তর দেওয়ান। দুজনই চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে জুনিয়র ও পাহাড় প্রেমী, একজন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ও অন্য জন ফোটোগ্রাফার। খুব সকাল সকাল বোটে যাত্রা শুরু করল রাঙ্গামাটির সবচেয়ে দূর্গম উপজেলার উদ্দেশ্য। ব্যাগভর্তি জিনিস ও গিয়ার্স নিয়ে যাচ্ছি অজানা সফরে। পচা নীল গভীর জলরাশি ফেলে রাঙামাটির বিশাল হ্রদটি অতিক্রম করছি – খেলনার মত দেখা যাচ্ছে রাঙামাটি শহরটি বিল্ডিং গুলো। সাদা ধবধবে পাখি গুলো হ্রদের মাছ শিকারে ব্যস্ত সময় খাটাচ্ছে। ছোট মাছ ধরার নৌকা নিয়ে জেলেরা কেউ কেউ জাল গুলো তুলতে এসেছে কেউ বা দলবেঁধে হ্রদে জাল তুলছেন।

হ্রদের বাতাস: কয়েক ঘন্টা পেড়িয়ে গেল রুপান্তর শশা দুটি হাতে নিয়ে বোটের ইন্জিনের পাশেঁ ছুরি দিয়ে শশা কাটতে কাটতে বলল দাদা বাইরে বাতাসটা বেশ মজার। শীতের মিষ্টি রোদ ও হ্রদের ঢেউ খেলানো বাতাস বোটের গতি বাড়িয়ে দিচ্ছে। একটু পরেই একটি বোট ঘাটে সেটলার (বাংগালী অভিবাসী) নেমে পড়ল- হ্রদের বেশিরভাগ এলাকা গুলো সেটলাররা দখলে নিয়েছেন ১৯৮০ দশকের পরে। বিশাল সংখ্যক সেটলার নিয়ে আসার ফলে এলাকা গুলো আদিবাসীরা সংখ্যায় লুঘু হয়েছেন নিজ এলাকাতেই। কোন এক ঝরে পাহাড়ের চিত্র চিরতরে পাল্টে যায়-১৯৬০ কান্নার চেয়েও গভীর ছিল ১৯৮০ কান্নাটি। যেখানেই পাহাড়ি গ্রাম ছিল সবাই উচ্ছেদ্য হয়েছেন, ততকালীন সেনাবাহিনী ও সেটলার দ্বারা। একটি পরে একটা সেনা ক্যম্পে বোট থামলো চেকিং করা হলো, আমাদের আইডি কার্ড দেখার পর মোবাইল নিয়ে ছবি তুলে চলে গেল। তারপর আবার বোটটি তার গন্তব্য দিকে যাত্রা শুরু করল, আমার পাশের সিটে এক সাদা পোষাকে পুলিশ সদস্যর সাথে পরিচয় হলো। তার পোস্টিং হয়েছে বাঘেরহাট জেলা থেকে এ দূর্গম পাহাড়ে , তার পাহাড়ে দু বছরের কাজের কথা বলতে গিয়ে বলেন এখানে সব পাওয়া যায়, বেশ ভাল রয়েছেন।
একটু পরে সেও বোটে ঘুমিয়ে পড়ল–
এরপর মোনঘোরে পড়ুয়া একদল দশম শ্রেনী ছাত্র সাথে পরিচয় হল।সে স্কুল বন্ধের সুবাধে তার বাড়িতে যাচ্ছে, তাদের সাথে একটি গিটার ছিল এবং সে লোকাল হওয়ার সুবাধে তার থেকে সব বিষয় জেনে নিচ্ছি কোথায় কি রয়েছে। দুজন মাঝ পথে একটি দ্বীপে নেমে গেল- খুব করে অনুরোধ করল যেন তাদের সাথে যাই।

প্রথম অভিযানের চূড়াটি দেখা যাচ্ছে : বোটে ছোট্টছোট্ট পা করে লাফিয়ে একটি শিশু উঠল। কাঠে ব্যাগ নিয়ে কোথায় যেন যাচ্ছে ; পরিচয় হলাম, সে পাশের একটি বৌদ্ধ বিহারে থাকেন এবং সেখান থেকে স্কুলে যান। কথার উত্তর গুলো খুব যত্নসহকারে দিচ্ছেন ছেলেটি, একটু পরে সেও গন্তব্য নেমে গেল।লাজুক চেহারায় হাত নেরে দিয়ে আমাদের বিদায় দিল। তপ্ত রোদে বোট গরম হয়েছে, বহু ছোট ছোট নালা ফেড়িয়ে বড় হ্রদে আবার পড়লাম। খানিক পর বোটে থাকা সেই দশম শ্রেণির ছেলেটিকে আমরা সাথে কথা বলতে লাগলেন, সুযোগে জ্বিগাস্সা করলাম। দূরের ঐ পাহাড় তার নাম কি? সে জেনে না জেনে উত্তর দিল। এরপর রুপান্তর তার কমেন্ট বসিয়ে দিল যে সেখানে দুটি বড় পাহাড় রয়েছে। পরিষ্কার কয়েকটি গ্রাম ও জুম দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের চূড়ায়। আমরা ঠিক করলাম সে পাহাড়েই রাত্রি যাপন করব। দুপুরবেলা কড়া রোদে পৌঁছালেন উপজেলা সদরে। সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল সুমন দাদার ভাগিনা। তিনটি বাইক নিয়ে তাদের বাড়িতে গেলাম। দিদির বাসাই দুপুরবেলা ভাত খাওয়ার পর এবার উদ্দেশ্য সে পাহাড়ের দিকে। পাহাড়ের উঠার আগে রংক্ষ্যক নদীর মোহনায় বাজারে উঠলাম, বাজারটি সেটলার(বাংগালি) ব্যবসায়ীর ভরা ছিল। সেখান থেকে আবারও মোটর বাইক নিয়ে শেষ পিচ রাস্তার পর্যন্ত্য গেলাম। ইট সেলিং এর রাস্তা শেষ হয়ে পাহাড় বেয়ে ভেলীতে পৌঁছালাম, সবুজে ভরা বেলীতে পাহাড়ি গ্রাম গুলো অসম্ভব সুন্দর। পাহাড় বেয়ে একদল স্কুল থেকে ফেরা শিশুর সাথে দেখা হল। কারো কাঁধে ব্যাগ কারো মুখে হাসি, ভেলী বেয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে বাড়ির উদ্দেশ্য।

বোটে দেখা হওয়া ছেলেটির সাথে দেখা:
সুন্দর উপত্যকা ধরে পাহাড়ের গোড়ায় যাচ্ছি, সাথে একদল শিশুও যাচ্ছে সাথে, যদিও তাদের উদ্দেশ্য অন্য গ্রামে যাওয়া আর আমাদের উদ্দেশ্য পাহাড়ে উঠা। উপত্যকার মাঝ বরাবর পাহাড়ি নদী বয়ে গেছে, সাথে বাশের তৈরী পাহাড়ি বাড়ি ও গ্রাম। বাঁশের সাঁকো বেয়ে নদী পার হয়ে একটি দোকান দেখতে পেলাম। দোকানে সকল বয়সের মানুষ জড়ো হয়ে ছায়াছবি দেখছে বড়বড় সাউন্ড করে। আমাদের দেখে তারা সবাই অবাক হয়ে থাকাল, আর জিগ্যেস করতে লাগল কোন দিকে যাচ্ছো? আমাদের উত্তর হল পাহাড় বেয়ে ওই গ্রামে যাব। দোকান ফেরিয়ে কিছুদূর এগোতেই সেই বোটে দেখা হওয়া ছেলেটির সাথে দেখা হল। তার বাড়িও সেই পাহাড়ের চূড়ায় গ্রামে, কয়েক মাস পর সে বাড়ি যাচ্ছে পরিবারের কাছে। খুব শান্ত স্বভাবের ছেলেটি আমাদের সাথে চলল- গত রাত হাল্কা বৃষ্টি হওয়ার কারণে ছোট্ট এ ছড়াটির পানির গতি বেড়েছে। আমাদের সাথে চলা স্কুলের শিশুরা রীতিমত লাফিয়ে লাফিয়ে ছড়া পার হলেও আমরা ছড়া পার হতে রীতিমত যুদ্ধ করছি।


কাঁধে ভারি ব্যাগ নিয়ে কষ্ট হচ্ছে বিদায় ছেলেটি আমার কিছু বোঝা নিয়ে দিল। একটু পর বাকি স্কুলের শিশুরা নিজ নিজ গন্তব্য চলে গেল – আমরা এখন বাকি থাকলাম মাত্র চার জনে, আমি, সাজাং,রুপান্তর ও ছেলেটি। একটি আখের বাগান পার করে একটি ছোট্ট দোকানে ছেলেটি তার মায়ের সাথে দেখা হল। তার মাকে বলল আমাদের বাড়িতে “গরবা” নিয়ে আসচ্ছি ভাত রান্না করে দিও। যদিও এর আগে তার বাড়িতে যাব এমন কথা হয়নি, কারন আমাদের যাওয়ার কথা হল সুমন দার মামার বাড়িতে। সে ওই পাহাড়ি গ্রামে থাকেন জুম চাষ করেন ও নানা ফলজ বাগান করেন। কিন্তু হুত করে ছেলেটি সবাকে আবদার করল আমাদের বাড়িতে যেতে হবে। যাহোক আমরা সবাই এমন আবদার আশা করেছিলাম অনেক আগে থেকে,কেননা পাহাড়ের মানুষ গুলো অনেক সরল প্রকৃতির হয়।তারা আগন্তক কোন অতিথিকে ফিরিয়ে দেয় না এটা এক রকমের সাংস্কৃতি মধ্য পরে।
দোকানে চা ও নানা গল্প করার পর আবার সামনে এগিয়ে গেলাম।

পরীদের পুরনো পাহাড়ি গ্রামে পৌছালাম :
পাহাড় বেয়ে উঠতে উঠতে সবাই ক্লান্ত শরীর নিয়ে একটি জুমের “রান্নিতে” বসলাম। একটু পরে এক গ্রামের মেয়ে বিশাল বোঝা নিয়ে পাহাড় নামতে দেখলাম। জিগ্যেসা করে জানতে পারলাম সে রাঙামাটি যাচ্ছে,সেখানে সে পড়শোনা করেন কলেজে। ক্লাস শুরু হবে তাই সে রাঙামাটি শহরের দিকে যাচ্ছে। পাহাড়িদের কাছে পড়াশোনা মানে বিশাল কিছু, কারন শিক্ষিত সমাজ ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পথ দেখাবে সেটা তারা জানতে পারছে, সেজন্য সবাই পড়ালেখা করার জন্য কঠোর পরিশ্রম করছে।
পাহাড়িদের কাছে পড়াশোনা মানে শুধু শিশুদের পরিশ্রম না! তার সাথে বাবা-মাকে কঠোর পরিশ্রম করে বেশি জুম চাষ করতে হয়, কারন ফসল বিক্রি করে সে টাকা ছেলেমেয়দের কাছে পাঠাতে হয়। সে এক অন্য কোন দিন কথা হবে, অবশেষে মেয়েটিকে বিদায় দিয়ে আবার এগিয়ে গেলাম। ছেলেটি উচু পথ বেয়ে নিয়ে গেল আমাদের- সন্ধ্যা না হতেই পাহাড়ি গ্রামটির দেখা পেলাম। কি অদ্ভুত গ্রাম!
কখনও আশা করিনি এ গ্রামে জমি দেখতে পাব। ছয় একরের মত জায়গা সমান এখানে, এ সমান জায়গাটি নাকি পরীদের বাসস্থান তাদের মতে। অনেকে এখানে ধান চাষ করেছে আর অনেক জমি পরে রয়েছেও। গ্রামে প্রথম জমিটিতে এক বৃদ্ধ দম্পতি কাজ করছেন, তাদের জমিতে। খুব হাসিখুশি চেহেরার এই দম্পতি সাথে কথা হল। জানত পারলাম তাদের সন্তান রাঙামাটি বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছেন। তাদের সন্তানের জন্য তাদের গর্বের কথা শুনে আমার মনে বেশ শান্তি লাগল। এক কষ্ট, এত জীবন সংগ্রাম করছেন ছেলেকে পড়ালেখা করে শিক্ষিত করার জন্য তা বর্ণনা করার মত নয়।
একটু সামনে এগিয়ে গিয়ে দেখলাম একটি দোকান,যেখানে গ্রামের সবাই জড়ো হয়ে রয়েছেন। ছক্কা খেলা খেলছেন একদল মধ্য বয়সি ছেলের দল ও অন্যরা বসে আসেন অলস সময় পার করছেন। আমরা ছেলেটি বাড়িতে যেতে যেত বিকাল নেমে এল- তাদের বাড়িটি বাঁশের তৈরী উচু ঘর, সাথে আরো একটি বাড়ি রয়েছে। তাদের উঠান থেকে বিশাল একটও ঝর্ণা দেখা যাচ্ছে, সাদা ধবধবে পানি পাথর বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। ছেলেটির বাড়িতে মা এবং বাবাই থাকেন শুধু, ছেলেটির মা-বাবা অনেক আন্তরিক। আমাদের দেখেই তার বাবা -মা খুশি হন এবং সাদরে গ্রহন করেন।

সূর্যাস্ত দেখতে চূড়ায় :
সন্ধ্যা নেমে এলেও গৌধুলীর হলদে রং দেখার জন্য সবাই পাহাড়ের চূড়ায় গেলাম। রুপান্তরের জোড়াজোড়িতে পাহাড় বেয়ে উঠলে লস নেই। কারণ কাপ্তাই লেকের বিশালতা ও গৌধুলীর ভরা বিকাল মনে রাখার মত। একপাশে কাপ্তাই লেকের বিশালতা, পাহাড় শ্রেণী আর অন্যপাশে আরও একটি উর্বর উপত্যকা ও দিগন্ত বিসৃত পাহাড় শ্রেণি। রান্নির একবারে উপরে বসে গৌধুলী দর্শন স্বর্গীয় – ঠিক সেখানে একটি বৃদ্ধ “ফুলসুমরি ” গাছ রয়েছে যা জুমিয়াদের কাছে হয়তো গুরুত্ববহন করে,সেজন্য রেখে দিয়েছে। সাজাং এর মতে ফুলসুমরি গাছ নাকি বাতাস আটকে রাখে, তার পুরো ট্রেকিং এ কথাটি কয়েকবার বলতে শুনেছি। সে ফুলসুমরি গাছ দেখলেই সেখানে আটকে যান,তার সৌন্দর্য ও সখ্যতা উপভোগ করতে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে এত,পুরো পাহাড়টিতে পাখির ডাক বন্ধ হয়ে গেল- এখন রাতের নীশাচরদের সময় চলে এসেছে। খুব তাড়াহুড়া করে আমরা চূড়া থেকে ছেলেটির বাড়িতে চলে আসলাম। কারণ, সবার কাছে পাহাড়টি নতুন ও পুরনো ভৌতিক কাহিনী থাকার কারনে নেমে আসলাম। সবাই মনে হয় জানেননা পাহাড়ি পরী হলা নামে পরিচিত, সেহেতু পুরনো কাহিনী তো থাকবেই।তাছাড়া এখানে প্রকৃতিই রাজত্ব করেন – মানুষ তার অংশ মাত্র। রাতের খাওয়া পর বেশ জমিয়ে আড্ডা হয় আমাদের- কোথায় থেকে কোথায় যাচ্ছি তা ঠিক নেই। মূলত, এ পাহাড়িদের বাড়িতে ঘুরেঘুরে থাকা শুরু করেছি ২০২০ সালের শেষের দিকে, সেই থেকে ডজন কানেক উপত্যকায় পাহাড়িদের বাড়িতে অচেনা অতিথি গিয়েছি ছেলে হয়ে ফিরে এসেছি, কি অদ্ভুত বন্ধন না?
যাহোক সবাই ক্লান্ত হয়েছে, তাই ঘুমিয়ে পড়লাম জুম পাহাড়ে কোন এক পরিবারের সন্তান হয়ে। ঝর্নার ঝঝঝ শব্দ ও পাখি-পোকার শব্দে নিভীর ঘুমের যাত্রায় চলে গেলাম।

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s