গুপ্তধনের সন্ধানে “ভূলংতুলি ” মোন- Searching for hidden treasure of Bhulongtuli Mountain (1st part of 3) by Supan Chakma

অবতরণিকা : পার্বত্য চট্টগ্রামের পাহাড় শ্রেণি গুলোকে “টারশিয়ারী” যুগের পাহাড় বলা হয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রায় দশটির বেশি সুউচ্চ মোন রয়েছে যাদের উচ্চতা সাগর পৃষ্ঠ থেকে তিন হাজার ফুট। তার মধ্য সাফা হাফং,তাজিউডং, কপিতাল,রাং তালাং অন্যতম। প্রতিটি সু-উচ্চ পাহাড়ের নিজস্ব গল্প ও ইতিহাস রয়েছে, রয়েছে নামের পিছনে নানা গল্প ও ইতিকথা। ঠিক, তেমনি রাঙ্গামাটি জেলার অন্যতম রহস্যময়ী সু-উচ্চ পর্ব্বত বলা হয় “ভূলংতুলি” মোনকে । আজ আমি রহস্যময় ভূলংতুলি মোনরে (বড় পাহাড়) ইতিহাস ও আমার যাত্রা তুলে ধরবো।

From the top


ভূলংতুলি মোন নিয়ে প্রচলিত কথন :
পাহাড়টি এতই দূর্গম যে সেখানে যেতে হাজারো বাধাঁ অতিক্রম করতে হয়। প্রচলিত রয়েছে ব্রিটিশরা যখন এ অন্ধল দিয়ে যায় তখন নাকী এখানে গুপ্তধন রেখে যায়। সে নিয়ে লোক মুখে নানা গল্প ও ইতিকথা রয়েছে। একবার এক শিকারি সেখানে শিকার করার সময় একটি সিন্ধুক খুজেঁ পায়। সে যখন নাকি সেটি নিয়ে আসার জন্য তার শিকারি বন্ধুকে বলতে যায়। ফিরে এসে সেই সিন্ধুকটি তারা আর পাওয়া যায় নি। প্রচলিত রয়েছে সেই গুপ্ত ধনটি জীবিত হয়েছে। অপর আরো একটি প্রচলিত কথা হল যে, সে গ্রামের লোকেরা নাকি এখনও পাহাড়টি কম্পিত হতে শুনতে পান। এটি সাধারনত অমাবস্যাতিথি ও পূর্নিমার সময়ে বেশি হয়ে থাকে। এছাড়াও পরীদের আস্ত একটি গ্রাম নাকি রয়েছে ভূলংতুলি মোনের চূড়ায়।



তিন ভাইয়ের যাত্রা : আমি সুপন চাকমা আমার ফুফাতো ভাই সজীব দাদা এবং ছোট ভাই স্মিত তিন জনে মিলে ভূলংতুলি মোন যাওয়ার জন্য পরিকল্পনা করলাম। শুনেছি আমার মায়ের দূর-সম্পর্কের আত্নীয়রা ভূলংতুলি মোনের পাদদেশর গ্রামে গত ৬০ বছর ধরে বসাবাস করে আসছেন। তাদের খোঁজ নিতে এবং ভূলংতুলি মোনকে স্বচক্ষে দেখার জন্য পরিকল্পনা করলাম। সে গ্রামের একজন পড়ুয়া ছেলে দাদাদের স্কুলে পড়াশুনো করে। তাকে আমরা গাইউ হিসেবে নিলাম। প্রথম দিনে গন্তব্য হল দীঘিনালা থেকে উত্তর-পূর্ব হয়ে তিরিশ (৩০) কিলোমিটার দূরে মোনের পাঁশে শেষ গ্রামে যাওয়া। এটি এতই দুর্গত ও অরক্ষিত বলার মত নয়। এখানে পদে পদে পাহাড়, খাদ, ঝিরি, ঘন বন যা আমাদের জন্য সোজা নয়।



রহস্যময় যাত্রার প্রথম দিন:
সকাল ছয়টার দিকে বাবুছড়া থেকে রওনা দিলাম সাথে নিলাম দুঃপুরের জন্য কিছু শুকনো খাবার ও পর্যাপ্ত পানি। নানা বন্ধুল পথ দিয়ে যেতে হয়, কখনও ঘন বাশ বন বা কখনও অন্ধকার ঝিরির পথ তাই সাথে কিছু ঔষধ ও সাথে নিলাম। ১০ কিলোমিটার হাটাঁর পর এক ঝিরি পথে প্রবেশ করলাম চারদিকে অন্ধকার কোন মানবের শব্দ নেই। এরপর পাহাড় ভেয়ে আবার এক ঘন বাঁশ বনে প্রবেশ করলাম আমার জীবনে এমন ঘন এবং বড় বাশ বন জীবনে দেখিনি প্রায় আট পাঁচ কিলোমিটার ধরে নিবিড় বাশ বন । গাইড বললো দশ বছর আগেও এ পথে নাকী অনেক বন্য হাতির প্রচুর আনাগোনা ছিল। কিন্তু এখন দেখা যায় না আর। ঠিক, দুঃপুর দুইটায় “লক্ষীছড়ি” নামক একটি গ্রামে পৌছায়। এ গ্রামটি দুটি ছড়ার মোহনায় সৃষ্টি হয়েছে। গ্রামের বাড়ি গুলো ছন পাতা ও বাশঁ দিয়ে তৈরী। সমাধানত, চাকমা আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা এই লক্ষীছড়ি গ্রামটি । রয়েছে ছোট্ট একটি বাজার সেখানে কিছু মানুষ বসে রয়েছেন। সবাই চাকমা অন্য জাতির কোন ছিটেফোঁটাও নেই। কিছু উৎসুক মানুষ আমাদের দেখে এগিয়ে আসলেন পরিচিত হলেন।


মূলত, এখানকার মানুষ গুলো “হাত্তোন” ও জুম চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে। খুব চিরায়ত সরল স্বভাবের মঙ্গোলিয়া চেহারার জুমিয়া মানুষ গুলো শত-বছর ধরে এ অন্ধলে জুম চাষ করে জীবন সংগ্রাম করছে। অতন্ত্য পরিশ্রমী ও সাহসী এ জুমিয়ারা,এরা আমাদের পূর্ব-পুরুষরদের ঐতিহ্যর ধারা এখনও বহন করছেন। যাহোক, দুঃপুরের খাবার সেখানে শেষ করে আবার সেখান থেকে একদম উত্তরে ঘন বনের দিয়ে যাত্রা শুরু করলাম। পাশে পাহাড়ি নদীতে কিছু শিশু বালি দিয়ে মূর্তি তৈরী করছে, কেউবা বাঁশের চালী নিচে নামাচ্চে। এখনকার গন্তব্য আরো গভীরে যেখানে যেতে ১২ কিলোমিটারের একটি বিশাল বন ফেলে যেতে হয়। এ বনে রয়েছে শান্তিবাহিনী সাথে সেনাবাহিনীর যুদ্ধের এক ইতিহাস।



শতবছরের বৃক্ষের সাথে সাক্ষাত : লক্ষীছড়ি থেকে গ্রামের মেঠোপথ ধরে পাহাড়িদের গ্রাম গুলো ফেলে যাচ্ছি এখন ঘড়ি কাটা ঠিক ২:৩০ বাজে। উত্তরের এ গ্রাম গুলোর নাম উল্লেখ করব না। কারণ এ এলাকা গুলো অতন্ত্য গভীরে হওয়ার জন্য নিরাপত্তা স্বার্থে গ্রাম গুলোর নাম উল্লেখ করব না। যাহোক বিকাল তিনটা দিকে এক ঘন বন শেষ করে একটি বিশাল দৌত্যকার্য বৃক্ষের বনে প্রবেশ করলাম। এ বনের ধরনটি বাকি বন গুলো থেকে আলাদা। এ বনে নানা পাখি ও বানরের সংখ্যা বেশি সাথে বড় বড় দৌত্যকার্য বৃক্ষ জীবনে প্রথমবার দেখা। আমরা তিন ভাই সাথে গাইড ও এক পথচারী পাচঁজন মিলেও এ গাছ গুলোর ব্যাস বা প্রস্ত হাত হাত রেখে মাপতে পারিনি। এত বিশাল বিশাল বৃক্ষ দেখে আমি হতবাক। নিজেকে খুব ছোট মনে হয়েছে সেই শত বছরের বৃক্ষের সামনে। পার্বত্য চট্টগ্রামে এত বড় বড় বৃক্ষ গুলো আমাদের ইতিহাস ও এ বনের ইতিহাসও সম্পর্কে জানান দেয়। যাহোক সেখান থেকে আবার শেষ গ্রামের দিকে যাত্রা শুরু করলাম।


শেষ গ্রামে পোঁছালাম : ঘড়ির কাটা এখন পাঁচটা( ৫) বাজে! ঘন বন ফেরিয়ে এক ভেলীতে পোঁছালাম। বাঁশ পাতার চালা দিয়ে তৈরী ঘর গুলো দেখতে খুব সুন্দর লাগে। পাঁশে বয়ে যাওয়া ছোট্ট ছড়া। ঠিক যথা রীতি নিজের নিজের আত্নীয় বাড়িতে পৌঁছালাম। অথচ কেউ কাউকে জীবনে দেখতে পায়নি। শুধু শোনা কথায় তিন ভাই মিলে আসা – আত্নীয় ” জেদে মা “আমাদের দেখে আবেগে আপ্লুত হন। সরল স্বভাবের “জেঠিমা” দেখতে আমার মায়ের মত ছোট ছোট চোখ আর ফর্সা। প্রথম দিনের যাত্রাটি এখান পর্য়ন্ত্য ছিল। এটি ভূলংতুলি মোনের যেতে শেষ গ্রাম কারণ এখান থেকে ভূলংতুলি চূড়ায় আহরণ করতে আরো দুই দিন লাগবে। সে রাতে শিকারির সাথে সাক্ষাত।

শিকারি সাতে সাক্ষাৎ : রাত সাতটার দিকে বাড়িতে খবর দেওয়া জন্য গ্রামের এক প্রান্তে গেলাম। বড় পাহাড় বেয়ে নেট খুজেঁ খুজেঁ বাড়িতে ফোন দিলাম যে আমরা পৌঁছে গেছি। এই গ্রামে একটি উচু পাহাড় রয়েছে সেই পাহাড় ছাড়া অন্য কোথাও মোবাইল নেটওয়ার্ক পাওয়া যায় না। মোটকথা গ্রামটিতে কোন নেটওয়ার্কই নেই। আর সেই পাহাড়ে এক শিকারির সাতে সাক্ষাত হয়। লম্বা সুঠমদেহী, চুল গুলো উচু উচু মধ্য বসয়ী । প্রথম দেখায় বলামাত্র ভূলংতুলি মোন যাবো।

তাকে বললাম “দা আমারে ভূলংতুলি মোন নেজা” সে বললো “হয়েকজন্নোই যে ন পারিবং, মানুষ লাগিবো, তুমি পারিবা নে, এত্তে যাদে দ সের -পাচ দিন দরিবু। আমরা বললাম দা পারিবাং তু বানা নেজা আর আমি পাচঁজন আগি তুইও মানুষ সা। (চাকমা ভাষায়)
পাহাড়ে মানুষরা সাধারনত সোজা প্রকৃতির হয়, সেও বলল “যেই সালে হেলি যদি উত্তু সের দিনর হরাগি লুইও। এভাবে সে রাজি হয়ে গেল।

তবে, আমাদের এক গাঁদা শর্ত দিয়ে দিলো বললো, ১| বেশি কথা বলা যাবে না,
২| হাসাহাসি করা যাবে না,
৩| কোন কিছু দেখলে শান্ত থাকতে হবে,
৪| আলাদা করে কোথাও যাওয়া যাবে না,
৫| সাবান বা গন্ধ জাতীয় কোন কিছু নেওয়া যাবে না এবং সাথে আরো অনেক শর্ত। নয়টা পর্যন্ত পরিকল্পনা করলাম। মূলত, ভাল্লুক ও বাঘ,হরিণ,বন্য শুকর,বানর , বন্য মহিষ সহ-নানা প্রাণি এখনও সে এলাকায় থাকায় কিছু শর্তও কৌশলের কথা বললেন। তাছাড়া ভূলংতুলি মোনের চূড়ায় একটি জায়গা রয়েছে যেখান দুই দিকে ঝিরি মাঝে শুধু ১০ ফুট যাওয়ার পথ সেখান শেষ মাথায় একটি বড় পাথর রয়েছে যেখানে নাকি একটি বড় বাঘ বসে থাকতো। ভাবা যায়?
তাছাড়া, বনের ভিতরে থাকতে হলে নানা শর্ত ও নিয়ম মানতে হয়। তারা এগুলো বিশ্বাস করেন এবং লালন করেন। এ বনের সাথে তারা পরিচিত জন্ম থেকে তাই তারা এ পরিবেশে কিভাবে ঠিকে থাকতে হয় সবকিছু জানেন। তারা এও বিশ্বাস করেন সেখানে কোন অলৌকিক শক্তির রয়েছে, রয়েছে গুপ্তধন । আমি একজন আদিবাসী তাই আমিও এ অলৌকিকতা ও প্রকৃতির রীতি-নীতি বিশ্বাস করি।
গ্রামের ৭০% মানুষ এ মোনটিতে এখনও যায়নি, নানা রহস্য নিয়ে আমরা চারদিনের প্রস্তুতি গ্রহন করলাম।
আমার মনের ভিতরে তখন কি যে কাজ করছিল তা বলে বুঝাতে পারবে না। এটি অলৌকিক শক্তির সংস্পর্শে যাবার জন্য নাকি দূর্গম প্রকৃতি কাছে যাওয়ার জন্য জানিনা
এ ভেবে ভেবে ঘুমিয়ে পড়লাম, সকাল হোক



ভূলংতুলি মোনের প্রথম পর্ব (২য় এবং ৩য় পর্বের অপেক্ষায় থাকুন)


লেখক-
সুপন চাকমা
বন ও পরিবেশ কর্মী, ইউটিউবার
বি.এ, এম.এ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়


শব্দার্থ –
মোন – বড় পাহাড়
ছড়া- ছোট ক্ষরস্রোতা নদী
ভূলংতুলি – ভূলংতুলি বন বিশেষ
জুন্ম- যে পাহাড়ি জুম চাষ করে জীবিকানির্বাহ করে
জুমচাষ – পাহাড়ে ভ্রমমাণ ফসল পলানো পদ্ধতি
হাত্তোন – এক বিশেষ ভাবে প্রাকৃতিক বনের উপর জীবিকানির্বাহ

আরো জানতে ইউটিউব এ ভিডিওটি দেখতে পারেন
চ্যানেল “হিলি বয় এইচ বি” Hilly Boy HB

আমার ফেইসবুক লিং
https://fb.watch/bfa3JyHHyr/

আমার ইউটিউব লিং
https://youtu.be/bNzL8oT7e8Q


https://fb.watch/bcZ-EA18_I/

Writer: Supan Chakma,
BA,MA, Chittagong University.

2 thoughts on “গুপ্তধনের সন্ধানে “ভূলংতুলি ” মোন- Searching for hidden treasure of Bhulongtuli Mountain (1st part of 3) by Supan Chakma

  1. বলোঙতুলি নাঙান বহুত শুন্নঙ,বিস্তারিত তরত্তুন হালকা জানিলুঙ।আমার আরো চিদু যানা উচিত।চিদুগর মানুজর সুখ দুখ,পরিবেশ নিনে রিচার্জ গড়ানা দরকার।

    গম লাগিলু হুব লেগাগান।আগজে বাচ্চে থেম নেক্সট পর্ব।

    Like

  2. লেগাগান দোল উয়ে তবে হয়েজ্ঞো বানান ভুল উয়োন | বাবুছড়াত্তুন লুক্ষিছুড়ি বাজার লুমদেগোয় তোমার হয় ঘন্টা লাক্কে ? আমি একবার মেলাছড়াত্তুন লামি ইজিসেদেয় বাবুছড়া রাস্তামাদা সঙ ৫ ঘন্টায় | লেদা দিক্কেয় | বুলঙতুলি মৌন যেবার মনে হর ত লেগাআন দেনেয় |

    Like

Leave a reply to Niku chakma Cancel reply